নিগমানন্দ ঠাকুর : সদ্য সমাপ্ত হোলিকা দহনের পরের দিন থেকে অর্থাৎ চৈত্রের নবরাত্রির তৃতীয় দিন থেকে ১৬ দিন ব্যাপী গাঙ্গোর পুজোর বিধান আছে শাস্ত্রে । উত্তর ও পশ্চিম ভারতে বিশেষ করে রাজস্থানে বাংলার দুর্গাপুজোর মতোই মহা ধুমধামে এই উৎসব পালিত হয় । কলকাতাও এর ব্যতিক্রম নয় । শহরের পশ্চিম প্রান্ত বড়বাজারে আগে এই উৎসব সীমাবদ্ধ ছিল । এখন জন বিস্তৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এই উৎসব পালিত হচ্ছে ।

২০০৯ সাল থেকে পূর্ব কলকাতা মাহেশ্বরী সভা সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের মঙ্গল কামনায় গাঙ্গোর উৎসব পালন করছে দু’দিন ব্যাপী । এবছর ৩ ও ৪ এপ্রিল কাঁকুড়গাছি সংলগ্ন রোজ ব্যাঙ্কয়েটে হাজার মানুষের সমাগম হয় । মূলত এই উৎসব পালিত হয় দেবাদিদেব মহাদেব, পার্বতী ও তাঁদের পুত্র গণেশের অর্চনার মধ্য দিয়ে । বিয়ের উপযুক্ত মেয়েরা মানত করেন মহাদেবের মত স্বামীর কামনায় । সদ্য বিবাহিত মেয়েরা অর্চনা করেন তাঁদের কাঙ্ক্ষিত মহাদেবের মত স্বামী পেয়ে । মেয়েরা গাঙ্গোর উৎসবে অংশ নিয়ে স্বামী সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন ।

দু’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিনোদন ও ক্রীড়া জগতের বেশ কিছু ব্যক্তিত্বরা এবং রাজনৈতিক নেতারাও । উৎসবের অন্যতম আয়োজক পূর্ব কলকাতা মাহেশ্বরী সভার সভাপতি এবং বিশিষ্ট চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী হেমন্ত মার্দা । তিনি জানালেন, “ধর্মীয় উৎসবের মধ্য দিয়ে মানুষের মিলন মেলায় থাকে তৃপ্তি সুখ । পূর্ব কলকাতা মাহেশ্বরী সভা বছর ব্যাপী সামাজিক দায়িত্বও পালন করে । কোভিড পরিস্থিতিতে মানুষের প্রয়োজনে খাদ্য, ওষুধ, ডাক্তার পরিষেবা এমনকি অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে রোগীদের সহায়তা করেছে । এ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার ব্যবস্থা করে রোগীদের হাসপাতালে পাঠানোরও ব্যবস্থা করেছে । এই বছর উৎসব উপলক্ষে প্রায় ২৫০জন আর্থিকভাবে দুর্বল ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলের প্রয়োজনীয় খাতা, পেন, পেন্সিল তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে । তবে এই সামাজিক দায়বদ্ধতাকে প্রচারের আলোয় আনার কথা ভাবা হয় না । সকলের হাসিমুখ দেখার মধ্যেই যে নিবিড় শান্তি ও তৃপ্তি আছে আমাদের কাছে সেটাই কাম্য ।” দু’দিনব্যাপী উৎসবের শুভ সূচনা করেন বৃহত্তর কলকাতা প্রদেশ মাহেশ্বরী সমাজের সভাপতি বিনোদ জাজু । তিনি বলেন, “পূর্বাঞ্চল মাহেশ্বরী সভা প্রতি বছরের মত এবারও উৎসবের আয়োজন যেমন করেছে তেমন বছর ধরে সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত থাকে । যা প্রশংসার যোগ্য ।” উৎসবের প্রথম দিনে স্থানীয় বিধায়ক ও পুরপিতা পরেশ পাল সংগঠনের প্রশংসা করে বলেন, “সামাজিক বিকাশের স্বার্থে সংগঠনের সব কাজেই যথাসাধ্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি ।” উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ভাওয়ার রাঠি, সুরেশ ঝাওয়ার, গোপাল দামানী, ভগবতী মুন্দ্রা, নারায়ণ মণিহার প্রমুখ । প্রথম দিনের পূজা পরিচালনা করেন বিজয় কোমল চান্দক । স্ত্রী আচারের অঙ্গ মেহেন্দি’র আয়োজন করেন অনিতা রাঠী ।প্রায় ২০০ মহিলা ভক্তকে মেহেন্দি পরান মঞ্জু ঝাওয়ার ও অঞ্জু ভূত্রা । মেহেন্দি অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যপূর্ণ রাজস্থানী গাঙ্গোর সঙ্গীত পরিবেশন করে তরুণীরা । সন্ধায় সংগঠনের সদস্য শিলজা ও বানোয়ারি বাহেটির বাসগৃহে অনুষ্ঠিত হয় সঙ্গীতানুষ্ঠান ।ভক্তিমূলক গান রচনা করেন শশী কোঠারি ও বিনয় লাহোটি । সঙ্গীতে অংশ নেন প্রায় ১৬ জন নারীপুরুষ ।শিল্পীদের তালিকায় ছিলেন ভামিকা মহতা, রুচিকা মাহেশ্বরী , পদ্মা বাগরি , রবি তাপারিয়া, গিরিরাজ কোঠারি প্রমুখ । গাঙ্গোর গীত পরিবেশন করেন রাজকুমার দুজারি ও গিরিরাজ কোঠারি । বড়বাজার অঞ্চলে গত ১৫০ বছর ধরে এই উৎসব পালিত হচ্ছে । পূর্ব কলকাতা মাহেশ্বরী সভার সদস্যা রতন বাহেটি বলেন, “উৎসবের মধ্য দিয়ে রাজস্থানী ঐতিহ্য অবলম্বন করে মানুষের সামাজিক মেলবন্ধন গড়ে তোলাই লক্ষ্য ।”
দ্বিতীয় দিনের পূজা পরিচালনা করেন রেশমি ও রাজেশ চান্দক । প্রায় দু’হাজার মহিলা ভক্তের উপস্থিতিতে উৎসব সফল হয়ে ওঠে । এই উৎসব সফল করে তুলতে সুনিতা বাহেটি, রাজকুমারী দামানী, লীলা মণিহার এর মত সদস্যাদের সহযোগিতা স্মরণীয় । উৎসবের দু’দিনে সমাজের বিভিন্ন স্তরের বহু বিখ্যাত মানুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয় ।