সপ্তপর্ণা বসু
Blame it on the mountains
জিপটা চলতে শুরু করেছে, শিলিগুড়ির ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা ছেড়ে আস্তে আস্তে দুধারে সবুজ চা বাগানের পথ ধরেছে। কলেজ পেরোনোর আনন্দে ভরপুর, কুড়ির দরজায় পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক সমাজে প্রবেশাধিকার পাওয়া কয়েকজন ছেলেমেয়ের জীবনোল্লাস জিপের অন্দরের হওয়ায় ভাসছে। সামনে ড্রাইভার ভদ্রলোকের পাশে বসে আছে রুপম। মাঝখানের সিটে ডানদিকের জানলার ধারে রূক্সার, দামি ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে ছবি তোলার চেষ্টা করেছে, আর বাঁদিকের জানলার ধারে সৃতমা, মোবাইলে মনোযোগী। এদিকে নারী স্বাধীনতা বলে চিৎকার করলে কি হবে জানলার ধারে সিট নেবার সময় সব ‘লেডিজ ফার্স্ট’। এই দুই এর মাঝখানে ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থায় পড়ে রয়েছে শিরোনাম।একদম পিছনের সিটে রয়েছে জয়ী, মৈনাক আর আরিয়ান। সমানে চিপস খেয়ে যাচ্ছিল ওরা আর একটা কোল্ডড্রিংকস-এর বোতল থেকে মাঝে মাঝে গলাদ্ধ করণও করছিলো।
তিস্তা বাজার ছড়িয়ে গাড়িটা পাহাড়ি পথ ধরছে। বাঁদিকে খাড়াই পাহাড় আর ডানদিকে বাঁকে বাঁকে তিস্তা। শিরোনাম পেছনের সিটে বসে থাকা মৈনাকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘চিপস আর কোল্ডড্রিংকসগুলো কি পেছনের সিটে বসার কমপেনশেশন! এদিকে পাঠা’
রুক্সার লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে যোগ করলো, ‘ওই খাদুগুলোর ওখানে রেখেছিস সব শেষ করে দেবে’
রুপম সামনের সিটে বসে আপন মনে রাস্তার দিকে তাকিয়েই ছিল এবার পিছন ফিরে বললো, ‘উফ তোরা খাওয়ার আলোচনাটা একটু রাখবি!’
আরিয়ান পিছন থেকে মন্তব্য করলো, ‘রাস্তাটা কিন্তু ফাটাফাটি করেছে’
জয়ী বলল, ‘লাস্ট যখন এসেছিলাম তখন it was very crooked’
মৈনাক বলল,’জাস্ট কোনও কথা হবে না’
সৃতমা মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞেস করলো, ‘কি নিয়ে?চিপস নাকি রাস্তা?’
হঠাৎ সামনের সিট থেকে রুপমের বিস্ময়বোধক চিৎকার, ‘oh my God!what a seen!’
জিপটা বেশ কিছুটা ওপরে উঠে এসেছে, বাঁদিকে তিস্তার জলে গাছের প্রতিবিম্বের ছাওয়ায় এক অদ্ভুত সবুজ আভা ধারণ করেছে।বাঁদিকে উলম্ব পাহাড়ের গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাথা উঁচু করা গাছের সারি আর তাদের পায়ের কাছে বাহারি রঙের ফুল, একটা পাহাড়ি ঝোরা রাস্তা ক্রস করে এপার থেকে ওপারে ছুটে চলেছে।
রুক্সার বললো, ‘আমাকে সামনের সিটটা দেওয়া উচিত ছিল, এখান থেকে ফটো তুলতে অসুবিধা হচ্ছে।’
শিরনাম শরীরটাকে খানিকটা এদিক-ওদিক করে নিয়ে বললো, ‘নেক্সট যেখানে গাড়িটা দাঁড়াবে তোরা জায়গাটা প্লিজ চেঞ্জ করে নিবি, আমারও অসুবিধা হচ্ছে, খালি গুতো মারছিস।’
রুপম বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোরা গুঁতোগুঁতি বন্ধ করে সামনে তাকা, জাস্ট ভাবা যাচ্ছে না,unbelievable!’
রুক্সার বললো, ‘তোর প্রথম পাহাড় দেখা তুই ভালো করে দেখ, রাতে পড়া ধরবো’
মৈনাক বললো, ‘সত্যিই তুই কোনওদিন পাহাড় দেখিস নি’ শিরোনাম বললো, ‘সবার জন্য সব-দেখা নয় ডিয়ার।’
আরিয়ান এতক্ষণ ফেলে আসা রাস্তার দিকে চোখ রেখে ছিল এবার গাড়ির ভেতর দিকে তাকিয়ে বসে থাকা বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘ও যা যা দেখেছে আমরা কি তাই তাই দেখেছি।’
জয়ী বললো, ‘no no no,never’
আরিয়ান বললো, ‘তুই শাহরুখ খানের সাথে বসে আইপিএল এর ম্যাচ দেখেছিস, হায়াৎ-এর লাউঞ্জে দিদিভাইয়ের বিয়ে দেখেছিস?’
শিরোনাম যোগ করলো, ‘ব্র্যান্ডেড জামাকাপড়ের পাহাড়টা অবশ্য…’
রুপম এবার ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, ‘ভাই লেগপুল করাটা বন্ধ কর নইলে নেমে যাব কিন্তু-‘
রুক্সার ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে কপট নির্দেশের সুরে বললো, ‘দাদা গাড়িটা একটু সাইড করে এই ছেলেটাকে নামিয়ে দিন তো।’
ড্রাইভার ভদ্রলোকও মুচকি হেসে বুঝিয়ে দিলেন তিনি বেশ বুঝেছেন। সৃতমার সামনে সিটটাতে রুপম বসেছে, খালি জলের বোতল দিয়ে মাথায় দুটো ধাক্কা মেরে সৃতমা বললো, ‘যা যা নাম।’
জিপটা আরো অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে, মেঘ করেছে পাহাড়ে, কিছু মেঘ গাড়ির সামনে, একটা বুনো গন্ধ ছড়ানো হওয়ায়, রুপম নাক দিয়ে নিঃশ্বাস টেনে গন্ধ নেবার আওয়াজ করে বললো, ‘ oh my God, smell of the nature, প্রকৃতির গন্ধ!ওরে এবার আমি মনে হচ্ছে মরেই যাবো।’
শিরনাম বললো, ‘প্রথম পাহাড় দেখার এক্সপ্রেশন-‘
রুপম বাধা দিয়ে বলল, ‘ প্রথম নয় 2nd.’
রুক্সার বললো, ‘তোর ওই দু বছর বয়সের মানালিটা কি countable !’
হঠাৎ গাড়িটা জোরে ব্রেক কসলো, সবাই তাল সামলাতে না পেরে এ ওর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল, রুপম চিৎকার করে উঠলো, ‘আরে আরে আরে!’
গাড়ির ভেতর থেকে আরো কিছু আওয়াজ ভেসে এলো, ‘একিরে ভাই’, ‘এক্ষুনি তো বাচ্চাটা…’, ‘একা এরকম ভাবে একটা বাচ্চাকে…’, ‘ওহ শিট…
বলতে বলতেই দেখা গেলো সামনে থেকে এক স্থানীয় মহিলা মাথায় ভারী কাঠের বোঝা জড়ো করা একহাতে সেটা আগলিয়ে দৌড়ে জিপের দিকে এগিয়ে আসছে। আর যে পথ চলতি বাচ্চাটিকে জিপটা প্রায় চাপা দিয়ে ফেলছিল সে ‘আম্মা’,’আম্মা’ বলে তার দিকে দৌড় লাগালো।ভদ্রমহিলা বাচ্চাটার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো আর কিযে বলতে থাকলো বোঝা গেলো না। জিপটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলে দেখা গেলো শুধু ওই ‘আম্মা’ নয় সামনে অপেক্ষারত আরো কিছু মহিলা তাদের সবার মাথায় শুকনো কাঠের বোঝা।
ড্রাইভার ভদ্রলোক বাচ্চাটির মাকে স্থানীয় ভাষায় কি বললো কে জানে তবে ‘আম্মা’ আর তার সঙ্গীরা হেসে গড়াচ্ছিল। ড্রাইভার যেন শহুরে মানুষের কাছে নিজের পাহাড়ের মানুষের হয়ে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, ‘ইয়ে লোগ জঙ্গল মে লকড়ি লেনে গেয়ে থে, ইয়ে লারকা পিছে রহে গয়ে।’
রুপম বললো, ‘কিছু হয়ে গেলে!’
ড্রাইভার বললো, ‘আদাত হ গিয়া ভাইয়া।’
রুক্সার বেশ রেগে বললো, ‘কিসকা আদত হো গিয়া, উন লোগো কা অর আপ লোগো কা?’
ড্রাইভার হেসে বললো, ‘সব হি কো দিদি।’
রুক্সার ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিশেষজ্ঞর মতামত দিলো, ‘ক্যালাস একটা কোনো sense নেই! বছর বছর বাচ্চা করবে আর এরকম রাস্তাঘাটে ছেড়ে দেবে।‘
সৃতমার ফোন এরমধ্যে নিচে পরে গেছে, সেটা খুঁজতে খুঁজতে আওয়াজ দিলো, ‘ক্যালাস্ নয় বাবু উদাস,হাসিটা দেখলি!’
মৈনাক বললো, ‘মাথায় কিছু না হলেও পাঁচ কেজি, সদ্য মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা সন্তান আর মুখে ওরকম অপর্থিব একটা হাসি কি করে পারে মাইরি!’ আরিয়ান বলল, ‘blame it on the mountains.’
রুপম ওর সেই পরিচিত উচ্চস্বরে বলে উঠলো, ‘ইয়েস,পাহাড়, the mountains!’
জিপটা বেশ অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে, মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে এখন হাত বাড়ানো নাগালে, ডান দিকে তিস্তা আর বাঁয়ে রঙিতকে রেখে এসে পাক খেতে খেতে গাড়ির ক্রমশ উপরে উঠছে, কেউ কোনো কথা বলছে না। রুক্সার ক্যামেরা লেন্সে চোখ রেখে বলে উঠলো, ‘সবাই প্লিজ একবার ডানদিকের নিচের দিকে দেখ’
সবাই জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে উদ্যত হলো।মৈনাক বললো, ‘পাকদান্ডি পথ বেয়ে তার বাগান ঘেরা বাড়ি’
রুপম বললো, ‘এবার আমি কেঁদেই ফেলবো”
সৃতমা বললো, ‘মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা মন খারাপ হলেই কুয়াশা হয় ব্যাকুল হলে তিস্তা।’
শিরোনাম পিছন থেকে রুপমকে ধাক্কা মেরে বললো, ‘কিরে নাম পছন্দ হয়েছে?’
জয়ী বললো, ‘কি নাম রে’
আরিয়ান বললো, ‘সব কিছু বাচ্চাদের জানতে নেই।’
মৈনাক বললো, ‘হয়েছে হয়েছে নইলে এক্ষুনি থ্রেট করতো, গাড়ি থেকে নেমে যাবে।’
সৃতমা রুপম চুলের মুঠিটা ভালোবেসে ধরে বললো, ‘কি রে মেঘপিয়ন নাম পছন্দ হয়েছে?’
রুপম সামনে থেকে মুখ না ঘুরিয়েই ওর হাত দিয়ে সৃতোমার হাত টা ধরে ফেললো,
জয়ী বললো, ‘Yes I got it, মেঘপিওন’
রুপম সৃতমার হাত টা না ছেড়েই গান গেয়ে উঠলো, ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো তুমি আমার।’
চলবে…