তপন চৌধুরীঃ একটি ছেলে ইস্কুলের পরীক্ষার শেষে তাঁর এক বান্ধবীর উদ্দেশে একদিন আচমকাই লিখে ফেলল একটি কবিতা। কবিতার নাম দিল ‘একটি চিঠি’। কবিতা তো লিখলো এবার তা যদি প্রকাশিত হয় না হয় তাহলে লোকে জানবে কীভাবে? এই সব ভেবে ছেলেটি সেই কবিতাটি ডাকে পাঠিয়ে দিল বিখ্যাত একটি পত্রিকার অফিসে। কিছু না বুঝে পাঠানো সেই কবিতাটি একদিন সেই পত্রিকাতে ছাপাও হল। এরপর তার বাড়ির ঠিকানায় একদিন এসে পোঁছাল একটি ভারী খাম। খামের ওপর লেখা সেই ছেলেটির নাম। ছেলেটি বেশ একটু ভয় পেয়ে গেল। তার নাম লেখা এত ভারী খাম, কী আছে ওর মধ্যে। খুলে দেখল সে; আরেব্বাস তার সেই কবিতা ছাপার অক্ষরে। ১৯৫১ সালের ৩১ মার্চ ‘দেশ’ পত্রিকার সংখ্যায় তাঁর লেখা সেই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে। সেদিনের সেই ছেলেটির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
কিন্তু কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে সেই কবিতার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একই নামে দু’জন বা একাধিক মানুষ থাকে, নিশ্চয় সেই আরেক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই সুনীল এই সুনীল নয়। কিন্তু এ কবিতা যে তাঁরই লেখা- কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না কারও। এমনকি যে বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে ছেলেটি কবিটাটি লিখেছিল সেও বিশ্বাস করলো না কবিতাটি তারই লেখা।
আসল ঘটনা হল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাবা তাঁকে টেনিসনের একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতিদিন এখান থেকে দু’টি করে কবিতা অনুবাদ করবে। এই কাজটা তিনি দিয়েছিলেন যাতে সুনীল দুপুরে বাইরে যেতে না পারেন। তিনি তাই করতেন। বন্ধুরা যখন সিনেমা দেখত, বিড়ি ফুঁকত সুনীল তখন পিতৃআজ্ঞা শিরোধার্য করে দুপুরে কবিতা অনুবাদ করতেন। অনুবাদ করতে করতে একঘেঁয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই নিজেই একদিন লিখতে শুরু করেন।
তবে সেই যে বান্ধবীর উদ্দেশে চিঠির আকারে লেখা কবিতা লেখা শুরু করলেন সুনীল তারপর ধীরে ধীরে জড়াতে লাগলেন সাহিত্যজগতে। কফি হাউসের আড্ডা, হৈ-হল্লা, সম্পূর্ণ বোহেমিয়ান জীবন, অবিরাম লিখে যাওয়া এবং পত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদিতে এমনভাবে জড়ালেন, এক জীবনে সেখান থেকে আর বেরোতে পারেননি। ‘এক জীবনে’ নামে তাঁর একটি উপন্যাসও আছে। আবার তাঁর আত্মজীবনীর নাম ‘অর্ধেক জীবন’। ‘অর্ধেক জীবন’ নাম দিলেন কেন? এ কথার উত্তরে সুনীল মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘জীবনের সব কথা তো লিখতে পারিনি! বাঙালি লেখক হিসেবে লেখা সম্ভবও না। অর্ধেক লিখেছি, বাকি অর্ধেক স্মৃতিতে চাপা পড়ে রইল।’