ঊর্ণনাভ
সুবর্ণরেখা নদীর একটি টিলার উপর সীতা বসে । তার সামনে রুক্ষ মানভূম। নদী, জঙ্গল ও পাথর। নেপথ্যে ব্যবহার হয়েছে সরোদ ও মৃদঙ্গম। সীতা আপনমনে গেয়ে চলেছে। ভৈরবী রাগের ব্যবহার — ‘অলি দেখো ভোর ভঁয়ি’। তার খেয়ালও নেই পেছনে তাঁর দাদা ঈশ্বর তাঁর গান শুনছে। এই গানের রেশ ধরেই ঈশ্বর পরবর্তীতে একটি মন্তব্য করে — ‘সবসময় এমন উদাস উদাস গান করিস কেন বলতো?…ওসব মানুষ পছন্দ করে না। সুন্দর জিনিস দেখাবি, তবেই তো মানুষ দেখবে, শুনবে পড়বে।’
অর্থাৎ মানবতার নিত্য নিয়ামক অবস্থান যেখানে ঝরাপাতার মত খুলে খুলে পড়ে, অস্তিত্বের যাবতীয় সাবজেক্টিভ মোটিফ যা টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় কালের নির্বান্ধব পুরীতে — সেখানে জীবনের এক অন্তর্হিত স্ববিরোধ থেকে জন্ম নেয় অদম্য সম্ভাবনার এক রিজেনারেশন ধারা। সমাজ ও সভ্যতাকে বিনুর কচি কোমল হাত টেনে নিয়ে যায় অনন্তে। মৃত্যু ঘাত বিড়ম্বনা সেখানে দুর্বল। মুহূর্তেক কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তোলে বটে তারপরেও জীবন অপরাজিতের, তার বহতা স্রোত যেন চোরাপথেও বইতে থাকে — কখনো লয়হীন কখনও তরঙ্গময়; কখনো বিষাদ কখনও শুদ্ধ কোমল নিষাদ।
সুবর্ণরেখার নদীপার্শ্বে শুকানো পাথরের টিলায় সমাহিত যে শত শত বছরের মৌন নিরালাপ অপেক্ষা এবং সীতার বিরহকালীন নিঃসঙ্গতা ঋত্বিক এমন অভিনব উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন যেখানে সমস্ত বেষ্টন খুলে গিয়ে জীবন যেন অফুরন্ত, নির্ভার, বাগ্ময়। আর এই অবিসংবাদী নিঃশূন্যতা থেকে গড়িয়ে আসে সংগীতের ভৈরবী সুর। জীবনের এই না ফুরোনো কথার চিন্তাসূত্রটিই ঋত্বিকের ছবির উপজীব্য বলে মনে হয় —
গানটির শুরুর দৃশ্যে যেখানে ক্যামারাটিকে নদীগর্ভে ছড়িয়ে দিয়ে তুলে আনা হচ্ছে সুবর্ণরেখার নদীগর্ভ, এবড়োখেবড়ো পাথুরে টিলার বক্ষ ফাটিয়ে সরু সুতোর মত জেগে থাকা নদীর ক্ষীন জলধারা। তারই মধ্যিখানে পাথরের গায়ে বসে আছে সীতা। কিরণপটে কুয়াশাঘন দিগন্ত। সীতার কন্ঠ থেকে আগমনী সুর — ‘অলি দেখো ভোর ভঁয়ি’, নেপথ্যে মৃদঙ্গের সঙ্গে বেজে চলছে সরোদ। কিন্তু এই রুক্ষ নিরস মাটিতে কাশ কোথায়? ভোরের হাওয়ায় কাশের ঝালর দুলিয়ে শরতের যে স্নিগ্ধ ভোর তার অভাব এই মানভূমে থাকলেও পাথরের ফাঁকে কয়েকটা কেশো ঘাসের দোদুল্যমান দৃশ্যকে তুলে ধরে শরতের সিম্বলিক বার্তা দিয়ে বোঝালেন এই শৈল আবদ্ধ যজ্ঞভূমিতেই মিথিলা কন্যা সীতার জন্ম। একদিন এই পাথরের বুক চিরেই উঠে এসেছিল সীতা। ঈশ্বর, যার মূর্ত চরিত্রটি এখানে অনাদি-বহমান জনকত্বের সাক্ষর রেখে মিডশটে প্রবেশ করছেন ফ্রেমের ভিতর। দূর থেকে দেখছেন আত্মনিমগ্ন সীতাকে। শূন্যে তাকিয়ে আপনামনে গেয়ে চলেছে সীতা — ‘লোক জাগে, পবনও জাগে, পঞ্ছি জাগে, গগনও বিরাজে’ — আদ্যাশক্তিতে প্রাণ ফিরে পেয়ে যেন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ করে মোটা প্রস্থর খন্ডটি বাগ্ময় হয়ে উঠছে — ‘এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর, / এত সুখ আছে, এত সাধ আছে – প্রাণ হয়ে আছে ভোর।’
সীতার এই জননীসুলভ আদ্যারূপটি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে রয়ে গেছে আমাদের চেতনা জুড়ে। ভারতীয় নারীরা আজন্ম অবচেতন স্তরে পালন করে এসেছে যুগ যুগ ধরে। ছবিতে সীতাকে পুতুল খেলতে দেখা যায় না, অর্থাৎ যেন জন্ম থেকেই সে মাতৃত্বের কবজ কুন্ডল নিয়ে জন্মেছে এই পৃথিবীতে। তাঁর ইচ্ছা অনিচ্ছা সব যেন এই আদলের যাঁতাকলে পিষ্ট। ঈশ্বর যেখানে পিতৃত্বের সমূহ সম্ভাবনাকে নিয়ে আসে সীতা সেখানেই স্নেহশীল, মাতৃপরায়ণ ভূমিকা পালন করে। ঋত্বিক এই চিরাচরিত গভীর নির্ভরতা আর মমত্বে গড়ে ওঠা আদলটিকে আচমকা ভেঙে দেন একটা দ্বন্দ্ব এবং প্রশ্নের মধ্যে — যখন জানতে পারে সীতা ও অভিরাম পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসে এবং তারা বিবাহের জন্যও প্রস্তুত। অন্যদিকে অভিরামের মা বাগদি বৌ-এর মৃত্যু, আচমকা একটা কো-ইনসিডেন্সের জার্ক ঈশ্বর অভিরাম সীতাকে ত্রিভুজের তিন কোণে ঠেলে দেয়। ঈশ্বর অস্বীকার করে সত্যকে। অভিরাম অস্বীকার করে তার অস্তিত্বকে। সীতা অস্বীকার করে তার মাতৃত্ব আদলটিকে। সেটিকে ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ে অভিরামের হাত ধরে।
নেপথ্যে কোথাও না কোথাও ভৈরবীর মধ্যে অশনি বিষাদের মূর্ত এই রূপটি সরোদের তারে ভিন্ন দ্যোতনা রচনা করে। অর্থাৎ এক ব্রাহ্মণ কন্যা পরিনীতা অপেক্ষা করছে ‘বাগদি’ দলিত সম্প্রদায়ের মাতৃপিতৃহীন অভিরামের পথ চেয়ে। পরবর্তীতে যার হাত ধরে দাদা ঈশ্বরের অমতে বিবাহের দিন গৃহত্যাগ করে। এবং নানান সামাজিক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নবজীবন আরম্ভ করে আত্মহত্যায় শেষ। সীতা, সতত পরিবর্তনশীল; অস্তিত্বের প্রতি একটা প্রশ্নচিহ্ন।
‘শ্যাম তু শোবত আব তু কাহে’ — ক্যামেরা পান করে সীতার মুখ ছেড়ে ঘুরে যাচ্ছে মরা নদীর শুষ্ক বালিগর্ভ ধরে। লংশটে লেন্সে ভেসে আসছে নিদীর চরা পাড়, অরণ্যরার ঝোপঝাড়, টিলাময় চাতাল, কুয়াশা ঘেরা পাহাড়, উপত্যকা ধরে চলে গড়িয়ে যাচ্ছে নদী সুবর্ণরেখা। যেন পুরাণ বর্ণিত অলকনন্দার ধারা। এইসব শিলা কুয়াশার মাঝে যেন জটাধারীর প্রচ্ছন্ন অধিষ্ঠান। দূরে অগভীর খালের জমা জলে চিকচিক করছে সকালের আলো। এবড়োখেবড়ো টিলার পাশ দিয়ে চাদর মুড়ে হেঁটে যাচ্ছে ছোট্ট অভিরাম। এই দৃশ্যটা কিছুটা অ্যানোমালেস্টিক। এমনটা কখনও ঋত্বিকের ছবিতে দেখা যায়নি যেখানে বর্তমানকে সামনে রেখে প্যারালাল একটা অতীতের কোনো ফ্লাসব্যাককে তুলে ধরা হয়েছে। ঋত্বিক এই কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্যটার থ্রু দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন শৈশবে বিচ্ছেদকালীন মূহুর্তটি সীতার অবচেতনে কতখানি পীড়িত করে তুলেছে তাকে; তারই পথ চেয়ে আজকের সীতার বিরহাতুর অপেক্ষা — মুঠো আলগা করে ঝুর ঝুর ঝরে পড়ছে জীবনের না বলা মৌন নিরালাপ শব্দ—বাসনা—প্রেম। ঈশ্বরের চোখে যার বাক্যাশ্রিত অর্থ — ‘হঠাৎ মনে হল তুই যেন সত্যি বড়ো হয়ে গেছিস’।
সমস্ত ছবিটাই যেন একটা কবিতা। জীবনের একটি সম্পূর্ণ চক্র বৃদ্ধ ঈশ্বরকে আবার ফিরিয়ে আনে বিনুর হাত ধরে নতুন ঘরের সন্ধানে। পুরোনো পুথির পাতায় লেখা দিয়ে শুরু হয়, এবং শেষ হয় জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, চিরজীবিতের। পুনরায় বর্ষা আসে। দু-কূল ছাপিয়ে নদীর কলকন্ঠস্বর পাথরের বুকে আছাড় খেয়ে বয়ে মঙ্গলমন্ত্রে উচ্চারিত হতে থাকে সীতার ফেলে যাওয়া গানের বন্দীস — অলি দেখো ভোর ভঁয়ি।
1 Comment
Comments are closed.