সন্দীপন বিশ্বাস
মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে যে একটা বাংলা বিভাগ আছে, সেখান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্লাস হয়, গবেষণা হয়, বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের কাজ হয়, এটা আমি জানতেই পারতাম না, যদি না আলেকজান্দার দানিলচুকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হতো। এও জেনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন একজন রুশ। তিনি স্বয়ং দানিলচুকই। এটা ১৯৮৪ সালের কথা। ময়দানে কলকাতা বইমেলায় নরম রোদে বসে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। দারুণ বাংলা বলেন। বাংলাতেই আমরা কথা বলেছিলাম। বাংলা সাহিত্যকে তিনি একের পর এক অনুবাদ করছিলেন। পুরনো থেকে নতুন। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র থেকে শঙ্খ, শক্তি, সুনীল।
দানিলচুক বৈষ্ণব পদাবলীও পড়েছেন। জানিয়েছিলেন, বাঙালি কবিদের কবিতায় যে সৌন্দর্য চেতনা, প্রেমের উপলব্ধি, এমনকী মৃত্যুচেতনা প্রকাশ পেয়েছে, রুশ কবিদের বিভিন্ন কবিতায় সেই ভাব খুঁজে পাওয়া যায়।
মস্কোয় থাকার সময় খুব মনে পড়ছিল দানিলচুকের কথা। সেই সাক্ষাতের পর কেটে গিয়েছে ৩৭ বছর। মলিন, ছিন্ন হয়ে গিয়েছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাঁর নেওয়া সেই সাক্ষাৎকার। কিন্তু মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি দেখে আমার অধ্যাপক দানিলচুকের সেই স্মৃতি ফিরে এসেছিল।
দানিলচুক বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকদিনের সফরেই রাশিয়ার শিক্ষা, রাজনীতি, সেখানকার মানুষ সবকিছু কত সহজেই বুঝে গিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, রাশিয়ার ভিতরের সুপ্ত জীবন দর্শনটুকুকে। কী গভীর সেই উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’ বইতে।
সত্যিই ‘রাশিয়ার চিঠি’র ভিতরে যে গভীর বোধের প্রকাশ রয়েছে, তা সেই সময়ের রাশিয়াকে চিনতে সাহায্য করে। রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ায় গিয়েছিলেন ১৯৩০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ছিলেন মাত্র ১৪ দিন। অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’ বইটির প্রথম চিঠি শুরু হচ্ছে এইভাবে- ‘রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল।’ প্রথম বাক্যটি পড়লেই বোঝা যায়, তাঁর অনেকদিনের একটা প্রত্যাশা পূরণ হল। ঠিক তাই। ১৯২৬ সালে কবিগুরু যখন স্টকহোমে, তখন সেখানে তাঁর আলাপ হয় সেখানকার রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দার অ্যারোসিয়েভের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে রুশ সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রুশ বিপ্লবের পর অনেক কিছুই কানাঘুষোভাবে কবির কানে আসছিল। তিনিও স্বচক্ষে বিপ্লবের ফলটুকু প্রত্যক্ষ করতে চাইছিলেন। অ্যারোসিয়েভকে তিনি বললেন, আপনাদের সাহিত্য, সঙ্গীত, থিয়েটার, নৃত্যশৈলী কত উচ্চস্তরের। তাছাড়া আপনাদের জীবনযাপন সম্পর্কেও অনেক কথা শুনেছি। সে সব দেখতে চাই।
অ্যারোসিয়েভ কবির ইচ্ছার কথা জানান নাট্যকার, সাংবাদিক আনাতোলি লুনাচারস্কিকে। তিনি তখন শিক্ষাদপ্তরের প্রধান। তিনি উদ্যোগ নিয়ে বার্লিনে গিয়ে কবিগুরুকে রাশিয়ায় আমন্ত্রণ জানালেন এবং সব ব্যবস্থা করলেন। তার আগে থেকেই অবশ্য রাশিয়ায় অব্যাহত ছিল রবীন্দ্রচর্চা। ততদিনে রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ রুশ ভাষায় প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। বেরিয়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের আংশিক রচনার সংকলনও। সেটির অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছিলেন লুনাচারস্কি। তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ হলেন ভারতীয় তলস্তয়। তাঁর সাহিত্যের যে প্রেম ও মানবতাবোধ, তা বিশ্বজনীন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে রুশ সাহিত্যিক বরিস পাস্তারনাক এবং ছয়ের দশকে বিখ্যাত রুশ কবি আনা আখমাতোভা তাঁর কিছু কবিতা ও গদ্য অনুবাদ করেছিলেন।
১৪ সেপ্টেম্বর কবি গেলেন মস্কোর একটা অনাথ আশ্রম দেখতে। তার নাম আলিসা কিনগিনা। ছোট ছোট অনাথ শিশুরা কবিকে ঘিরে ধরল। তাদের জীবনের কথা শোনাল কবিকে। কবি তাদের শোনালেন ‘জনগনমন অধিনায়ক’ গানটি। তখনও তা জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠেনি। ওদের সঙ্গে কবিও যেন শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর কবি দেখতে গিয়েছিলেন ত্রেতিয়াকোভ আর্ট গ্যালারি। তাঁর সফরকালেই মস্কোর স্টেট মিউজিয়ামে কবির আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। সেই ছবি দেখতে ভিড় উপচে পড়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে কবিকে সেখানকার শিল্পীরা উপহার দিলেন পাথরের তৈরি তলস্তয়ের মুখ।
২৪শে বিদায়ের আগে কবিকে বিরাট সংবর্ধনা দেওয়া হল সেখানকার পিলার হলে। রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী এবং নৃত্যশিল্পীরা পারফর্ম করলেন কবির সামনে। রুশ আবৃত্তিকাররা পাঠ করলেন কবির কবিতা। কেউ রুশ ভাষায়, আবার কেউ বাংলা ভাষাতেই কবিতাপাঠ করেছিলেন।
তাঁর রাশিয়া সফরের অভিজ্ঞতা নিয়েই ‘রাশিয়ার চিঠি’ বইটি। এই চিঠিগুলির প্রাপক ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে। রাশিয়ায় কবিকে দেখভালের জন্য একটা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তার নেতৃত্বে ছিলেন প্রাচ্যবিদ্যার অধ্যাপক সের্গেই ওল্ডেনবার্গ। তাঁদের উপরমহল থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কবিকে বেশি এদিক ওদিক দেখানো চলবে না। অর্থাৎ সত্যকে চাপা দেওয়ার চরম চেষ্টা করেছিলেন রুশ শাসকরা। কবি চেয়েছিলেন ইয়াসনায়া পোলিয়ানা যেতে। মস্কো থেকে তার দূরত্ব মাত্র দু’শো কিলোমিটার। এখানেই তলস্তয় জন্মেছিলেন। সেখানে সেই বাড়িতে বসে তিনি লিখেছিলেন ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘আনা কারেনিনা’। সেটি পরবর্তীকালে একটি মিউজিয়াম হিসাবে দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে। সেখানেও যাওয়ার অনুমতি মেলেনি কবির। আসলে শাসকরা চেয়েছিলেন, নিষ্ঠুরতম অত্যাচারের সত্যটুকু যাতে কবির দৃষ্টিগোচর না হয়। কিন্তু কবি নিজেই সত্যদ্রষ্টা। তিনি ঠিক বুঝে ফেললেন যে, এই সভ্যতা, এই শিক্ষার অগ্রগতির আড়ালে চলছে চরম এক নিষ্পেষণ। তিনি শুনেছিলেন সেখানে স্তালিনের একনায়কতন্ত্রে মানুষের নিষ্পেষণের কথা। আড়াল করার চেষ্টা হলেও তা তাঁর কাছে সম্যকভাবে ধরা পড়েছিল। তাই তিনি ১৩ নম্বর চিঠিতে লিখলেন, ‘মানুষের ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত সীমা এরা যে ঠিকমতো ধরতে পেরেছে তা আমার মনে হয় না। সে হিসাবে এরা ফ্যাসিস্টদেরই মতোই। ….এখানে জবরদস্ত লোকের একনায়কত্ব চলছে। এইরকম একের হাতে দশের চালনা দৈবাৎ কিছুদিনের জন্য ভালো ফল দিতেও পারে, কিন্তু কখনোই চিরদিন পারে না। … তাছাড়া অবাধ ক্ষমতার লোভ বুদ্ধিবিকার ঘটায়।’ এই ‘জবরদস্ত লোক’টি যে স্তালিন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর নিপীড়ন কবির মনকে পীড়িত করেছিল। সেই ১৩ নং চিঠির অনুবাদ পড়ে ব্যাপক গোঁসা হয়েছিল স্তালিনের। তিনি ওই চিঠিটি বাদ দিয়ে রাশিয়ার চিঠির অনুবাদ প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবার বইয়ের ‘উপসংহার’ পর্বে গিয়ে কবি লিখলেন, ‘ডিকটেটরশিপ একটা মস্ত আপদ। সে কথা আমি মানি এবং সেই আপদের বহু অত্যাচার রাশিয়ায় আজ ঘটছে সে কথা আমি বিশ্বাস করি।’ সত্যদ্রষ্টা কবি সেই ‘আপদ’ স্বৈরাচারীকে তীব্র ঘৃণায় বিদ্ধ করেছিলেন।
১৪টি চিঠি এবং উপসংহারের মধ্যে প্রথম তিনটি তিনি লিখেছিলেন মস্কোতে বসেই। তারপর তিনি বার্লিন চলে যান। মস্কো ত্যাগ করার আগে ‘ইজভেস্তিয়া’ সংবাদপত্র তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সেখানে সত্যপ্রকাশে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেননি কবিগুরু। সেখানে তিনি বলেছিলেন, সত্যকে উপলব্ধি করার স্বাধীনতাকে যদি হত্যা করা হয়, তবে সেই নিষ্ঠুরতাকে চরমমূল্য দিতে হয়। শ্রেণী ঘৃণা ও প্রতিশোধস্পৃহা সবসময় আদর্শের পরিপন্থী।
কিন্তু ‘জবরদস্ত’ স্তালিনের নির্দেশে সেই সাক্ষাৎকার সেন্সর করা হল। ছাপার অনুমতি পেল না ইজভেস্তিয়া। কবির সেই সাক্ষাৎকার ছাপা হল অনেক পরে। ১৯৮৮ সালে গর্বাচভের আমলে। তিনি এসে স্তালিনের পাপস্খালন করলেন। নতজানু হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলেন সেই নগ্ন সেন্সরশিপের। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে কবি বলে গিয়েছিলেন অমোঘ ভবিষ্যতের কথা। বলেছিলেন, ‘লাঠিয়ে পিটিয়ে রাতারাতি যা গড়ে তোলে, তার উপরে ভরসা রাখা চলে না। তার উপরে দীর্ঘকালের ভর সয় না।’ কবির এই কথন সত্য হয়েছে। অপশক্তির সেই দম্ভ চুরমার হয়ে গিয়েছে। ভেঙে পড়েছে সোভিয়েত রাশিয়া। বিদায় নিয়েছে স্বেচ্ছাচারীর প্রাণঘাতী দৌরাত্ম্য। আজকের অবাধ হাওয়ায় শ্বাস নেওয়া রাশিয়ার মানুষকে দেখে কবির সেই সত্য উপলব্ধির কাছে প্রণত হই।