ভারতীয় রান্না ঘরের ঝুলকালি

ভারতীয় রান্না ঘরের ঝুলকালি

কন্যা চক্রবর্তী

রান্নাবান্না। খুব সাধারণ একটা পরিচিত শব্দ বা বলা ভাল কাজ। ‘সাধারণ’ এবং ‘পরিচিত’ – এই দুইয়ের যুগলবন্দিতে ‘রান্না’ কাজটি কোথায় যেন কৌলিন্য হারিয়েছে আগেই। ‘রান্না’ র সেই কৌলিন্য হারানোর কার্য- কারণ তল্লাসি করেছে নতুন ছবি ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’।

ওয়েবে ছবি মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে ভরপুর প্রশংসা। অন্যান্য বারের মতোই এবারও রইল ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন ‘ সংক্রান্ত আলোচনা। রিভিউ না, ছবি দেখে কেমন লাগল তা বরং আপনারা নিজেরাই বুঝে নিন।

চলচ্চিত্রের কাহিনি অনুযায়ী একটি মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, নৃত্যপটু মেয়ে বিবাহসূত্রে একটি অত্যন্ত গোঁড়া রক্ষণশীল পরিবারের আসে। বিয়ের পর অচিরেই সংসার ধর্মে জড়িয়ে পড়ে সে। দায় দায়িত্ব, আবদার তো আছেই সঙ্গে যোগ হয় মধ্যযুগীয় কিছু বর্বর আচরণ। যেগুলিতে মধ্যযুগে তো বটেই আজকের দিনেও অনেক পরিবারই অভ্যস্ত। সেই মেয়েটির দৈনন্দিন অত্যাচারের দিনলিপি এবং তার পরিনাম নিয়েই এগিয়েছে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ – এর কাহিনি।

ছবির শিরোনামে ‘কিচেন’ শব্দটি দেখার পর ছবি দেখতে বসলে আপনার মনে হতেই পারে ‘কিচেন’ অর্থাৎ রান্নাঘর কোথায় যেন ছবিটির একটি চরিত্রই হয়ে উঠেছে। অন্যান্য রক্ত মাংসের চরিত্রের মতো সে কথা বলতে না পারলেও ভীষণ জলজ্যান্ত এই ‘কিচেন’। তবে এই রান্নাঘর থেকে শুধুই সুস্বাদু রান্নার গন্ধ আসে না, শৌখিন খাবারের প্লেট ডাইনিং রুমে পৌঁছোয় না, আদতে রান্না করার ঘর হলেও সে যেন অত্যাচারের পাকশালা। এখানে গলাটিপে মারা হয় মেয়েদের ইচ্ছে, স্বাধীনতা, স্বাভাবিকতা।

মুখে আমরা যতই উন্নতির বড়াই করি না কেন ভেতর ভেতর বর্বরতার ঘূণ কুড়েকুড়ে খেয়েছে সমাজকে। তাই আজও বাড়ির স্ত্রীদের ওপর যে ধরণের জুলুমবাজি চলে তাকে স্বাভাবিক বলেই মনে করে পুরুষশাসিত সমাজ। তাদের আচরণে যে কোন রকম প্রশ্ন উঠতে পারে তা মাথাতেও থাকে না পুরুষের। আর সেই প্রশ্নটাই ছুঁড়ে দিয়েছে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’। জিজ্ঞেস করছে, কেন মেয়েরাই রান্না করবে? পুরুষ কেন বসে বসে ফরমাইশ করবে? কেন খুব স্বাভাবিক একটা শারীরিক কারণের জন্য প্রতিমাসে প্রায় এক ঘরে হয়ে দিন কাটাতে হবে মেয়েদের?

বাড়ির মহিলাদের অনেকেই আজও নাম ধরে ডাকেন না। বিয়ের পর তারা যেন নামগুলো পূর্বাশ্রমেই ফেলে আসেন! আর তাই শ্বশুরবাড়িতে তারা কারুর ‘বউ’ তো কারুর ‘মা’ হিসেবেই পরিচিতি পান। ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ এও তাই বেশির ভাগ চরিত্রেরই নাম নেই কোন! ছবিতে ব্যবহৃত দৃশ্যকল্প নজর কাড়ে। সুনিপুণ হাতে নারী – পুরুষের দৈনন্দিন লড়াই-এর তুল্যমূল্য হিসাব দর্শিয়েছেন পরিচালক।

কথায় বলে, ছবি, চলচ্চিত্র, সাহিত্যকীর্তি এসবকে ভাষার বেড়াজালে বেঁধে রাখা যায় না।’ দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ একথার প্রমাণ। মালয়ালম ভাষার ছবি হলেও ইংরেজি সাবটাইটেল আর দৃশ্যের সাহচর্যে ছবি দেখতে গিয়ে একবারও হোঁচট খাবেন না দর্শক। দক্ষিণের রান্নাঘর কখন যেন বাংলার রান্নাঘরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে।

‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ – এর পরিচালক জেও বেবি। অভিনয় করেছেন নিমিষা সাজায়ান, সূরজ বেনজারামুরা, টি. সুরেশ বাবু, সিদ্ধার্থ শিবা সহ অনেকেই।

ভাষার জটিলতা নয়, ছবির কাহিনি দর্শকের ভাল লাগতে বাধ্য। ছবি দেখার পর হয়তো বা দক্ষিণের হাত ধরেই পাল্টে যেতে পারে দেশের কোনও না কোনও রান্নাঘরের দৈনন্দিন অত্যাচারের ঝুলকালি! কে বলতে পারে?

ছবি – দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন, পরিচালক – জেও বেবি, অভিনয় – নিমিষা সাজায়ান, সূরজ বেনজারামুরা প্রমুখ, রিলিজ – ওয়েব প্ল্যাটফর্ম (আমাজন় প্রাইম)

administrator

Related Articles