বৈঠকখানা ডেস্কঃ ৬০ বছর আগে অলিম্পিকের আসরে ভারতীয় এক তরুণ তাঁর দেশকে অলিম্পিক মেডেলের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহুর্তে সেই পদক হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। শুধু সেই তরুণের স্বপ্নভঙ্গ নয়, হয়েছিল গোটা দেশের।
তবে তরুণ মিলখা সিং-এর সেই লড়াই বিশ্বমঞ্চে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। গোটা দেশে তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন ফ্লাইং শিখ হিসাবে। সারা দেশবাসী তাঁকে এত ভালবাসা উজাড় করে দিয়েছিল যে তাঁর লড়াইয়ের জন্য মিলখা কিছুটা হলেও তাঁর পদক হারানোর বেদনা ভুলতে পেরেছিলেন।
মিলখা সিং প্রথম ভারতীয় অ্যাথলেট, যিনি ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ১৯৫৮ সালে কার্ডিফে কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যালকম স্পেন্সকে হারাতে তিনি ৪৬.৬ সেকেন্ড টাইমিং করেছিলেন। ২০১০ সালে দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসে ওই ইভেন্টে কৃষ্ণা পুনিয়া সোনা জেতার আগে পর্যন্ত ৫০ বছর স্মরণীয় ছিলেন মিলখা সিং।
প্রাক্তন সেনা সদস্য মিলখা সিং তাঁর দেশকে বহু গৌরব এনে দিয়েছেন। এশিয়ান গেমসে ৪ বার সোনা জিতেছিলেন। ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকে ৪০০ মিটার স্প্রিন্টের ফাইনালে চতুর্থ হয়েছিলেন। এছাড়া ১৯৫৬ এবং ১৯৬৪ সালে তিনি অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।
দিল্লিতে প্রথমে রিফিউজি ক্যাম্পে থাকাঢ় সময়েও মিলখার জানা ছিল না তাঁর পরিবারের বাকিরা কে কোথায় কিভাবে আছে। একদিন দিল্লিতে হঠাৎই খুঁজে পান তাঁর বোন ইশারকে। এরপর বোনের শ্বশুরবাড়ি হয় মিলখার নতুন আস্তানা। সেই অভিজ্ঞতাও মিলখার কাছে সুখের ছিল না। মিলখার মনে হয়েছিল, ‘ওটা তো বাড়ি নয়, যেন জেলখানা!’ আসলে ওই বাড়িতে ইশারের নিজেরই কোনও স্বাধীনতা ছিল না। সেখানে মিলখা থাকেন কি করে। ফলে একদিন সেই বাড়িও তাকে ছেড়ে দিতে হয়।
পেটের দায়ে একসময় রেলের ওয়াগান থেকে মাল চুরি করা শুরু করেছিলেন। একবার সেই মাল চুরি করতে গিয়েই ধরা পড়তে হয়। সেই শৈশবেই যেতে হয় তিহার জেলে। ১০ দিন জেলে থাকার পর বোন ইশারই কানের দুল বিক্রি করে মিলখাকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। মিলখা মনে রেখেছিলেন সেই ঘটনা। দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানে মিলখা কানের দুল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বোন ইশারকে। মিলখা ব্লেজারের দু’পকেটে দুটো কানের দুল রেখে দিয়েছিলেন। ইশারকে ডেকে মিলখা বলেছিলেন পকেটে হাত দিয়ে দেখতে। ইশারের দু’হাতে উঠে এসেছিল দুটো কানের দুল।
এখানেই মিলখার গল্পের শেষ নয়। দিল্লিতে একসময় এক দোকান পরিষ্কারের কাজও করেছেন, ১০ টাকা মাস মাইনেতে। ওই দোকান পরিষ্কারের কাজ করার পর সেনাবাহিনীতে চাকরি পান। অ্যাথলেটিক্সের শুরু সেখানেই। মিলখা এজন্য কৃতিত্ব দিতেন গুরু গুরদেব সিংকে। সেনাবাহিনীতেও তাঁকে চক্রান্তের শিকার হতে হয়েছে। একটা প্রতিযোগিতার আগের রাতে কয়েকজন কম্বল চাপা দিয়ে মিলখার পা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবু সারাজীবন ধরেই তাঁর আস্থা ছিল সেনাবাহিনীতে।
যে মিলখার জন্ম পাকিস্তানে। সেই পাকিস্তানই একদিন তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল মা–বাবা–দাদা–দিদিদের থেকে। সব ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল ভারতে। অনেক বছর পরে সেই পাকিস্তান থেকেই মিলখা পেয়েছিলেন ‘উড়ন্ত শিখ’ নামটি। নামটা দিয়েছিলেন পাকিস্তানের রাজনীতিক আয়ুব খান। পাকিস্তানের তখনকার সেরা রানার আব্দুল খালেককে পাকিস্তানের মাটিতেই হারিয়েছিলেন মিলখা। সেই দৌড়ের পর মুগ্ধ হয়ে আয়ুব খান মিলখাকে ডেকেছিলেন ‘দ্য ফ্লাইং শিখ’ নামে।
নিজের জীবনে অর্জন করা সব মেডেল, ট্রফি এবং সম্মান দান করে দিয়েছেন মিলখা সিং। সেগুলি ভারতের পাতিয়ালার স্পোর্টস মিউজিয়ামে রাখা রয়েছে।