ধূসর শহরের চিঠি

ধূসর শহরের চিঠি

দীপঙ্কর দাশগুপ্ত

কালের যাত্রাধ্বনি শুনিতে কি পাও? হে শহর, আত্মীয় শহর? সমর সেনের সেই ‘ধূসর শহর’, জীবনানন্দের ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা’ কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই ‘স্মৃতির শহর’। কলকাতার তিনশো ত্রিশটা জন্মদিন পার হয়ে গেছে। এমন কিছু রঙিন ছবি সেদিনও ছিল না। ক্লান্ত নাগরিক, ভিড়ে ঠাসা মেট্রো, নাক জ্বালা করা পেট্রোল- ডিজেলের পোড়া গন্ধে ঠাসা এভিনিউ, গলি আর ঘোলাটে বৃষ্টির জলে ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গিকাতর ভাদুরে কলকাতা যেমন থাকে প্রত্যহ, তেমনি ছিল। বিবর্ণ কলকাতা। রঙচটা কলকাতা, বিদ্রুপের কলকাতা।

অথচ কত না বর্ণনা আছে এই শহরের শরীর-মন নিয়ে। মহানগরীর রাত্রিকে কেউ লিবিয়ার জঙ্গলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেউ বা কালিঘাট ব্রিজের কাছে মেয়োনুষের সনাতনী পেশার সঙ্গে শহরের ক্লিষ্ট শরীরটার তুলনা খুঁজে পেয়েছেন।কেউ বা কলকাতার একফালি নাগরিক আকাশে কালজয়ী পাখনার চঞ্চল প্রকাশ দেখেছেন। এক ঝাঁক পায়রার আকাশবিহারে। কেউ বা কোনও বদ্ধ উন্মাদের দিশহারা চোখের সঙ্গে তুলনা করেছেন শহরের আকাশটাকে— যার নিচে পাঁচ ইস্টিশন পেরনো বারবার পিছিয়ে পড়ে পাগল বাব্বরালির মেয়ে সালেমন খুঁজে বেড়ায় তার মাকে। এই কলকাতা শহরের অলিগলির গোলকধাঁধায় কোথায় লুকিয়ে তুমি সালেমনের মা?

অলিগলির গোলকধাঁধা? নিশ্চয়ই তাই। কলকাতায় এমন গলিও আছে যেখানে যেখানে একটা মানুষ, কেবল একটা মানুষই হেঁটে যেতে পারে। উল্টোদিকে অন্য কেউ এলেই ট্রাফিক জ্যাম। কিপলিং যেমন বলেছিলেন— এ শহর ‘চান্স ডিরেক্টেড’। জব চার্নকের ‘নুন ডে হল্ট’ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের নির্বাচনী সফরের জন্য গড়ে ওঠা এই শহর। মাপজোক না করেই গড়া। কত গলি, কত বাড়ি খাড়া হল আড়াআড়ি জমে ওঠা ইটের বহরে। গলি এই শহরের প্রাণ, এ শহরের আত্মা। এ শহরে এমন অনেক লোক আছেন যারা ছকু খানসামা গলির বাইরে দুনিয়ার কিস্যুটি দেখেননি। ‘দেখেননি’ বললে কম বলা হয়, দেখতে চানও না। ‘‘কোথাও যাব না, গলিতে থাকব’’— এই হল এই শহরের ম্যানিফেস্টো।

না হয় তাই-ই। কিন্তু কার তাতে কী? এই শহরেরই চারণ কবি সুমন তো কবেই বলে দিয়েছেন, ‘‘এই যে দেখছি/আদ্যিকালের দেয়াল ফুঁড়ে/ জংলা গাছের বাচ্চা নাচে/ হাত-পা ছুঁড়ে/ কার তাতে কী?/ আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি?’’ স্বপ্ন দেখার জন্য আদ্যিকালের দেয়ালফোঁড়া গলির কলকাতা আদর্শ— আজকে নয়, সেই রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে, সেই কিনু গোয়ালার গলির দিনকালেই। যে গলিতে কান্তবাবু থাকতেন। কর্নেট বাজানো তাঁর শখ ছিল। মাঝে মাঝে সুর জেগে উঠত। সিন্ধু বাঁরোয়ায় তাল লাগত। সমস্ত আকাশে বেজে উঠত অনাদিকালের অনন্তবেদনা। ওই ইতিহাসটুকু এখনও রয়ে গেছে কলকাতার গলিতে।

আর গলি না চিনলে কোনও শহর চেনা যায়? মনে নেই অভিধান রচয়িতা ডক্টর স্যামুয়েল জনসনের সেই বিখ্যাত কথা: ‘‘লন্ডন শহরকে যদি চিনতে চাও তবে রাজপথে নয়, গলিতে এস।’’ ডক্টর জনসন বড় ভালবাসতেন লন্ডনকে। বলেছিলেন, ‘‘লন্ডন সম্পর্কে যেদিন আমি ক্লান্ত হয়ে যাব, বুঝতে হবে জীবন সম্পর্কেই আমি ক্লান্ত।’’

কলকাতা সম্পর্কেও কথাটা খুব খাটে। এই ‘জঘন্য’, ‘ওঁচা’, ‘পচা’ শহরটা সম্পর্কে যেদিন আমি ক্লান্ত হয়ে যাব, জানবো জীবন সম্পর্কে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।

administrator

Related Articles