রুমা ব্যানার্জি
অর্নবের মন ভালো নেই।কী ভেবেছিল আর কী হয়ে গেল।এতোদিনের স্বপ্ন, এক নিমেষে খানখান। কত আশা ছিল, বলতে গেলে সেই জ্ঞান হওয়া অব্দি।এই একটা দিন,শুধু একটা দিনইতো চেয়েছিল।তাও ভগবান মুখ ফিরিয়ে নিলেন।ওপরওয়ালা যে এত নিষ্ঠুর তা কে ভেবেছিল।অফিসের কিছু কাজ নিয়ে বসেছিল কিন্তু মন বসলে তো?
উঠে গিয়ে চুপি চুপি উঁকি দিলে বাবার ঘরে।হুম, যা ভেবেছিল তাই।মা সিরিয়াল দেখছে আর বাবা কাগজ হাতে নিত্যদিনের মতন ঘুমাচ্ছে।গোঁফের আড়ালে একটা মুচকি হাসি যে ঝুলছে, তা বুঝতে আর অসুবিধা হলো না।হবেই তো।হাসবেই তো।অফিসেও অরুনাভর মুখেও আজ এই হাসিটাই দেখেছে।যত দেখছে ততই ভিতরে ভিতরে জ্বলে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে ওকে দেখেই বোধহয় সবাই বেশী বেশী করে আসছে।এরকম জানলে অর্নব বিয়েই করতো না।সে তুমি যতই রূপবতী গুনবতী হও না কেন।
“প্রতারণা, প্রতারণা” বিড়বিড় করে বলে অর্নব, “আমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।”
বিন্নির বাড়ী থেকে বিয়ের আগে একবারও বলেনি বিয়ের আগে, যে ওদের জামাইষষ্ঠী নেই।হ্যাঁ ছোটবেলা থেকেই এই স্বপ্নটাই তো দেখছে অর্নব।যখন বাবা মায়ের সঙ্গে এই দিনটাতে মামাবাড়ি যেত,দেখত বাবার মুখে সেদিন যেন একটু বিশেষ রকমের হাসি।দিদার আদরযত্নও একটু স্পেশাল।অর্নব যে সেই আদরযত্ন থেকে বাদ যেত তা নয় তবু বাবার যত্নটা যেন একটু বেশিই ছিল সেদিন।অন্যসময় অর্নব সব আগে পেলেও, সেদিন বাবা সবেতেই আগে থাকত।বিশেষ করে ঐ সন্দেশটা।অর্নবের চোখের সামনে যেন এখনো ভাসছে,আহা!ইয়া বড় ক্ষীরের সন্দেশ,মাঝখানে বড় করে লেখা ‘জামাই ষষ্ঠী’।খেতে বসে সব কিছু পেলেও ঐ ‘জামাই ষষ্ঠী ‘ লেখা সন্দেশটা কোনদিনই অর্নবের জুটতো না।ওটা নাকি স্পেশাল। শুধু বাবা আর মেসোমশাইয়ের জন্য। সেইদিনই অর্নব ঠিক করে নিয়েছিল ও নিজে যেদিন জামাই হবে, সেদিন ও একাই খাবে ওইরকম সন্দেশ। কাউকে ভাগ দেবে না।
কত ত্যাগস্বীকারই না করলো এই একটা কারনে।ওদের পাড়ার মিষ্টি যে ওকে পছন্দ করতো তা কী ও বুঝতো না? দিব্যি বুঝতো কিন্তু সব জেনেও যে কোনদিন ওকে এতটুকু পাত্তা দেয়নি সে তো এই জামাইষষ্ঠীর জন্যই। মিষ্টির বাবা হারাধন বাবু যে রাম কিপটে সে তো এ পাড়ার সবাই জানে।ওদের জামাই হলে যে মোটেই জম্পেশ খাওয়াটি জুটবে না, এ ব্যাপারে অর্নব একশো শতাংশ নিশ্চিত ছিল।
সেই হারাধনবাবুও আজ সকালে ওর চোখের সামনে রিকশা ভর্তি বাজারেরব্যাগ নিয়ে বাড়ী ফিরলেন।এরপর কাল মিষ্টিও আসবে ওর চোখের সামনে দিয়ে।ও বারান্দায় বসে বসে দেখবে।দেখা ছাড়া আর উপায় কী?ওর অমন কড়া বস সেনবাবু পর্যন্ত যখন আজ নিজে ডেকে বললেন
“অর্নব কাল তো তুমি থাকছো না,সুজয়কে একটু সব বুঝিয়ে যেও।”
“কাল,থাকছি না? না, কেন?”
ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।উত্তরে মিস্টার সেন, হো হো করে হেসে উঠেছিলেন।
“হয়,হয়, প্রথম প্রথম এরকম হয়।তারপর দেখবে তুমি নিজেই আগেভাগে ক্যালেণ্ডারে দাগ দিয়ে রাখছো-কবে জামাইষষ্ঠী।”
চুপ করে গিয়েছিল।সত্যি বললে মানসম্মান থাকতো না।বাঙালির এই এক বিচ্ছিরি স্বভাব এমনিতে তো বাংলা মাস তারিখ জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারবে না কিন্তু এইবেলা সব মুখস্থ।
সব রাগ গিয়ে পড়ছিল বিন্নির বাবার ওপর। এদিকে তো ভদ্রলোক ‘ অর্নব অর্নব ‘ করে অস্থির,যেই দেখেছে বাড়ীতে মেয়ের সংখ্যা বেশী অমনি জামাইষষ্ঠীটাই দিয়েছে তুলে।ভারী চালাক।সত্যি বিন্নিদের বাড়ীতে মেয়ের সংখ্যা একটু বেশীই। বিন্নিরা দুই বোন।ওর কাকার দুই মেয়ে,এছাড়া জ্যাঠা, পিসে যেদিকে তাকায় সব মেয়ে।সেইজন্যই আর কী…।বুদ্ধি বলিহারি। অর্নবের মা একবার বিন্নির কাছে মিনমিন করে বলেছিল, নিয়মকানুন না থাক অন্তত খাওয়া দাওয়াটাও তো চলতে পারে।বিন্নি পত্রপাঠ না করব দিয়েছে।ওদের বাড়ী নাকি এসব ব্যাপারে খুব কড়া।হুম,তা আগে জানিয়ে দিলেই হতো।বৈশাখের এই পচা গরমে ঘন্টার পর ঘন্টা আগুনের সামনে বসে বিয়ে করার ঝক্কি তো এই জন্যই নিয়েছিল অর্নব যাতে জামাইষষ্ঠী হাতছাড়া না হয়।ধুস,ভাগ্যটাই খারাপ অর্নবের।
বারান্দায় এসে সিগারেট ধরালো অর্নব।ঐ যে হারাধনবাবু আবার বেরোলেন বড়ো ব্যাগ হাতে।নিশ্চিত কালকের বাজার এখনো শেষ হয়নি।নাঃ,অস্থিরভাবে উঠে দাঁড়ালো অর্নব।আর নেওয়া যাচ্ছে না।সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
***
ভোর থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে।কদিন খুব গরম ছিল।জামাইষষ্ঠীর আগে প্রতি বছরই এরকম পচা গরম পড়ে।
“আমার ঠাম্মা বলতো, একে বলে কাঁঠাল পাকানো গরম।জামাইদের জন্য কাঁঠাল পাকছে।”
বলতে বলতে হিহি করে হেসে উঠলো বিন্নি।
“তোমাদের তো জামাইষষ্ঠীই নেই।কাঁঠাল পাকলেই কী আর না পাকলেই কী?”
“কী করবো বলো?বাড়ীর বড়োরা যা নিয়ম করে গেছেন।নাহলে…”
ঠোঁট উলটে উত্তর দিলো বিন্নি।
অর্নব আর কথা বাড়ায় না।ও আজকে আর বারান্দাতেও যায়নি।বসে বসে ল্যাপিতে ওয়েব-সিরিজ দেখছে।মা বেরিয়ে গেছে মামাবাড়িতে।
যাবার আগে অবশ্য বলেছিল, ” আমরাও বেরিয়ে যাচ্ছি,তোরাও বরং একটু বেরিয়েই আয়।”
বিন্নি রাজী হলো না।
“অর্নব,খেতে এসো।”
বেলা ভালোই হয়েছে।খিদেও পেয়েছে।
ও চুপচাপ খাবারের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো।
“এ কী! কি করেছো?”
এতোকিছু রান্না করেছে বিন্নি।মাছের চপ,পোলাও, মাটন,চিকেন কষা,চাটনী, পায়েস আর পাতের এককোনায় জ্বলজ্বল করছে একটা ইয়া বড়ো সন্দেশ-যার ওপর বড়বড় করে লেখা -‘ জামাই ষষ্ঠী ‘।
“কী করেছো?”
অবাক চোখে বিন্নির দিকে তাকিয়ে থাকে অর্নব।
“কাল থেকে দেখতে পাচ্ছি,ব্যাজার মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে একজন। তাই তার মন ভালো করার একটা চেষ্টা, আর কী? “
“সন্দেশটা কোথায় পেলে?”
“কোথায় আবার? জামাইষষ্ঠীর সময়ে সব মিষ্টির দোকানেই পাওয়া যায়।”
মনটা খারাপ হয়ে যায়,বেচারীকে একটু বেশিই কথা শুনিয়ে দিয়েছে ও।কাজটা ঠিক হয়নি।
“কী ভাবছ? অতো ভেবো না, আমি তোমার জন্য কিছুই করছি না।শুধু জামাই ষষ্ঠীটা একটু প্র্যাকটিস করে রাখছি,আমাদের মেয়ে হলে করতে হবে তো জামাইষষ্ঠী? “
অর্নবের ইচ্ছে হলো ছুট্টে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বিন্নিকে,কিন্তু সেটা পরে হলেও হবে,এখন আপাতত ওর চোখের সামনে অপেক্ষা করছে ওর অনেক দিনের স্বপ্ন,সেটাতেই বরং মনোযোগ দেওয়া যাক।সন্দেশটা হাতে নিয়ে এক কামড় বসালো,”আহা! কী বানিয়েছে!”
বিন্নি শুধু চোখ মটকে বলল ” হ্যাপি জামাইষষ্ঠী।