অন্তরাত্মা

অন্তরাত্মা

অর্পিতা ঘোষ পালিত

রাকেশের বেশ কিছুদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, আজ ভিড় বাসে ঠেলাঠেলি করে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে কোনোরকমে হাতমুখ ধুয়ে ধপাস করে খাটে শুয়ে পড়লো।

টুপুর তখন ছেলেকে পড়াচ্ছিল, সামনের সেশনে স্কুলে ভর্তি করতে হবে ঋজুকে। রাকেশ ঘরে ঢোকার পরে ঋজুকে ওর পছন্দের খেলনা দিয়ে, রান্নাঘরে গিয়ে একটু মুড়িমাখা আর সাথে চা নিয়ে এসে দেখে রাকেশ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।

– কি হোলো তোমার, শরীর খারাপ করছে?

– উ-উ

– ওঠো, চা মুড়িটা খেয়ে নাও…হাত দিয়ে টুপুর গায়ের তাপমাত্রা দেখলো, যা ভেবেছে ঠিক তাই, আজও গা গরম।

রাকেশ উঠে বসলো, মুড়ির বাটিটা হাতে নিয়ে বললো– দারুন করে মেখেছো দেখছি… তোমার কই?

– আমি আজ খাবোনা, পেটটা ভার ভার লাগছে।

– তাই হয় নাকি, আমি একা খাব,  নাও হা করো।

মুড়ি মুখে নিয়ে খেতে খেতে টুপুর বললো– তোমাকে নিয়ে আর পারিনা, বলছি আমার আজ খেতে ইচ্ছে করছে না, তাও তোমার জন্য খেতে হবে।

– হবেই তো, তুমি তো জানো, তোমাকে ছাড়া আমি একা কিছু খাইনা, কোথাও যাইনা, এক অফিসে ছাড়া। আমার কলিগরা তো তাই বলে… আমি নাকি বউয়ের আঁচলের তলায় থাকি।

– তাই বলে বুঝি, তা তুমি কি উত্তর দ্যাও?

–আমি, আমি ওদের বলি… আরে ভুল বললে তোমরা, কথাটা চেঞ্জ করে ওড়নার তলায় বলো, এখন তো আর শাড়ির আঁচল খুঁজে পাওয়া যায়না। সবাই তখন হেসে ওঠে।

– তুমি তাই থাকো নাকি?

– তোমার জন্য আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সব করতে পারি, ওরা তো জানেনা আমি তোমার দিওয়ানা…

– ঠিক আছে বাবা, তবে এই রবিবার তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। রোজ জ্বর আসছে, একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া ভালো।

– ওকে, তুমি যা বলবে তাই হবে।

টুপুরের দিদির বাড়ি ওর ভাড়া ফ্ল্যাটের থেকে মিনিট দশেকের পথ। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় ঋজুকে দিদির কাছে দিয়ে তারপর গেল। ঋজু খুব খুশি মাসিমনিকে পেয়ে।

ডাক্তার একগাদা টেস্ট করতে দিলেন। প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে রাকেশ। দু’দিন ছুটি নিয়ে টেস্ট করিয়ে, রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে গেল।

রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন– কঠিন রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। এক সপ্তাহের মধ্যে অপারেশন না করলে জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে।

টুপুর– অপারেশন করতে কত খরচ হবে ডাক্তারবাবু?

–এই রোগের এক একটা ইনজেকশনের দাম অনেক। সব মিলিয়ে চার লাখ টাকার মতো খরচ হবে।

সেদিন সারারাত ঘুম এলোনা টুপুরের। কি করবে, কি করে বাঁচাবে রাকেশকে? দিদি একলাখ টাকার মতো দিতে পারবে। গয়না আর ব্যাঙ্কে জমানো টাকা সেরকম নেই। পাঁচবছর হলো নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে, রাকেশ চাকরি পাবার পরপরই। দুবছরের মাথায় ঋজু এলো। টুপুর নীচু জাতের মেয়ে বলে রাকেশের বাড়ি থেকে সেভাবে মেনে নেয়নি।

রাকেশ গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ওর বাবা পুরোহিত, আর অল্প কিছু জমি-জায়গা আছে। রাকেশ পড়াশোনায় ভালো ছিল বলে হোস্টেলে রেখে শহরের কলেজে পড়িয়েছেন। কলেজে পড়ার সময় থেকেই টুপুরের সাথে সম্পর্ক, চাকরি পাওয়ার পর বাড়িতে টুপুরের কথা বলেছিল রাকেশ। বাবা মেনে নেয়নি বলে বাড়ির অমতে টুপুরকে বিয়ে করেছিল। তখন থেকেই বাড়ির সাথে রাকেশের সম্পর্ক ভালোনা।

লজ্জার মাথা খেয়ে পরদিন শ্বশুরকে ফোন করলো টুপুর। সব শুনে বললেন– একলাখ টাকার বেশি উনি দিতে পারবেন না। রাকেশের বোনের বিয়ে দিতে হবে, তখন জমি বিক্রি করবেন। টুপুরকে বাকি টাকা জোগাড় করতে বললেন।

টুপুরদের পাশের ফ্ল্যাটে মাসখানেক আগে নতুন ভাড়া এসেছে। টুপুরের থেকে একটু বড় এক দিদি ও তার স্বামী থাকে। বিকেলে ওই দিদির সাথে দেখা হওয়াতে জিজ্ঞাসা করলো– তোমার মুখটা কিরকম যেন লাগছে, কিছু হয়েছে কি?

টুপুর সব কথা উজাড় করে বলে দিয়ে কাঁদতে লাগলো।

দিদি বললেন– সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে, কোনো চিন্তা কোরোনা। একটু আমার ঘরে এসো, কিছু আলোচনা করবো তোমার সাথে।

টুপুর ওই দিদির কথা শুনে খুশি মনে ওনার ঘরে গেল।

এই প্রথম এলো টুপুর ওই দিদির ফ্ল্যাটে, আভিজাত্যে পরিপূর্ণ সাজানো গোছানো। টুপুরকে দিদি বললো– তুমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে ফেলো, টাকা যা লাগবে আমি দেবো।

টুপুর আনন্দের আতিশয্যে বললো– কি বললে দি, তুমি দেবে? কি বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ জানাবো বলে বোঝাতে পারছি না।

– আমার নাম লিজা, তুমি আমাকে লিজা বলে ডাকতে পারো।

– আমি তোমাকে লিজাদি বলে ডাকবো।

– তোমার স্বামী যে কদিন নার্সিংহোমে থাকবে, সে কদিনের রাতগুলো তুমি আমায় দেবে; বিনিময়ে তোমার নার্সিংহোমের পুরো বিল আমি পেমেন্ট করে দেবো

– রাতগুলো তোমায় দেবো মানে, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না…

– তুমি শিক্ষিত মেয়ে, না বোঝার কিছু নেই। কদিনের তো ব্যাপার…কেউ জানতে পারবে না। তোমার স্বামী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে।

টুপুর চুপ করে বসে থাকলো কিছুক্ষণ, চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলো, তারপর আস্তে আস্তে বললো– আমি রাজী লিজাদি, আমার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি…তবে আমার ওপরে ওর অগাধ ভরসা…

ডাক্তারের কাছে টুপুর একা গিয়ে সব ঠিক করে ফেললো। ডাক্তারকে বললো, আমার স্বামী রাকেশ যদি কিছু জিজ্ঞাসা করে আপনি কিছু বলবেন না,  বলবেন শুধু ওষুধের দাম নিয়েছেন, আর কিছু নেননি।

চলবে …

administrator

Related Articles