ঊর্ণনাভ
ভাঙা জানালার ওপাশে দেহাতি চরাচর। খোড়ো চাল। সনাতন বাগচীর বাড়ি। রতনপল্লীর নিহিত শকুনক্রান্তি সন্ধায় সে বাড়িটাকে ছেড়ে এসেছি। কবেকার বৈশাখের এলোমেলো হাওয়ায় সেই এক কিশোরবেলার বন্ধ দরজা বারবার কড়া নেড়ে খোলার চেষ্টা অব্যাহতি দিয়েছে মনেহয়। লন্ঠনের আলোয় পাঠরত ধ্রুবতারাজ্জ্বল চোখ, পাংশু ছায়া, ফিরিওলা দিন — পঙ্গপালের মত ঘাড় কাত করে অঙ্ক কষার রাত — নিঃসপত্ন নীড়ের মত শুনশান; কপর্দকশূন্য।
তারপরেও চকের দাগের মত আবছায়া একটা দাগের ইতস্তত বিক্ষেপ থেকে যায়। দেউলিয়াত্বের কাশজ্বর থেকে যায়। আম্রকুঞ্জের লাল মরামের উপর যখন আমার শিশুকালবয়স্ক ছেলেমেয়েরা বকুলফলের বাঁশি বাজিয়ে ঝিঁঝিঁ মৌনতা ভেঙে দেয়, ঘু ঘু দুপুরে নীল পাথুরে ঢেউ দেয়, পিছন থেকে গোল্লা গোল্লা মেয়েটির হাত ‘পক্ষী ভালো’ ছেলেটির চোখ চেপে দেয় তখন ঝাপসা লেগে যায়।
সেইসব রূপকথা-উপকথা-ফেবল্-প্যারাবলের মাধ্যমে বারবার একটা ভাঙা দেওয়ালের কথা মনে পড়ে যায়। যার এককোণে পেয়ারা গাছের বাকল ছাড়াতে ছাড়াতে একটা গোমড়ামুখো ছেলে, এক্কেবারে নিঃস্ব হাত দুখানা বাড়িয়ে বলে — একদিন এই পৃথিবীর সমস্ত নিরালোক শোক আমি মুছে দেব। ঊষার সীমান্তে এমন এক দোয়েল বাসা বানাবো যেখানে চুরি করবে না কেউ আমাদের উষ্ণ তা দেওয়া ডিমগুলো। ভালো-থাকা দিনগুলো৷
বারংবার মনে হয়, এসব অব্যর্থ অত্যাচারের কারণেই। শান্তিনিকেতনের ভিতরে বারিণের মন বসে না। ভাঙা পোড়ো বাড়িটা সেও এক স্মৃতিকাতরতায় জুলজুল চেয়ে থাকে সারাক্ষণ। দুপুর হলেই স্নেহশীল প্রত্নছায়ার উপদ্রব বেড়ে যায়। তমিস্রা লেপা মাটির সিঁড়েতে জেগে ওঠে সমপ্রাচীন না-ফুরোনো আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনের শোক। ছুঁচে গাঁথা জীবনের এলোমেলো বর্ণাক্ষর। শীতলপাটি বিছিয়ে কবেকার এক মৌন হুল্লোড়। গোর্কির প্রিয় কেদারায় এখন মিসকালো বেড়াল দম্পতি শরীরের বসন্ত শুকায়। বারান্দাময় পড়ে থাকা ছাগল নাদি। চর্মচটকের বিষ্ঠা। কড়ি থেকে মাটি খুলে খুলে পড়ে অনবরত। শুকানো নিম কাঞ্চনের পাতা। উঠান ভরে আছে প্যাপাইরাস ঝুমকোলতার জঙ্গল। যজ্ঞডুমুরের বন। রু রু নির্জনে ঘুঘুর মরণ ঘুমের ডাক। বাজকুড়ুলের ক্লান্ত চীবর পাখসাট। একজনকে ছাপিয়ে অন্যজনের এক নির্মম বিরোধ। অমলতাস দিনরাত্রির সাথে নামহীন বনলতার সাথে এ এক বিষম যুদ্ধ চলে সারাক্ষণ।
এরই মাঝে কখন যে পশ্চিমে মেঘ জমলো, কখন আঁচলখসা ছায়া ঘরের ভিতরের চীনালন্ঠন নিভিয়ে দিয়ে গেল কে তার খবর রাখে। বারিণ এসব পৌঢ়ত্ব থেকে দূরে শ্যামবাটীর পথ ধরে বোশেখের খড়কুটোর মত ভাসতে ভাসতে স্বভাবসিদ্ধ হারিয়ে গেল। শুধু তার আবছা নোনা ধরা সবুজাভ পাঞ্জাবিটা একবার স্বর্ণপ্রভার ডালে একবার গুলমোহরের ডালে সনির্বন্ধ অনুরোধে কিছুক্ষণ আটকে রইল…থেমে রইল… উদাসীন, মাতাল, শয়তান — অতঃপর সব একাকার করে বৃষ্টি নেমে এলো বিয়োগ প্রসবা বৈশাখীর…
1 Comment
Comments are closed.