সতেরো পর্ব

সতেরো পর্ব

সপ্তপর্ণা বসু

অনুভূতি

আজই সন্ধ্যায় অনুরাগের অঞ্জায়োগ্রম হয়েছে,তিনটে আর্টারিতেই অনেকটা করে ব্লক আছে,বাইপাস করার কথা ডাক্তার বলেছেন অথবা স্টেন্ট বসানো যেতে পারে। বাইপাস এখনই করা যাবে না,সদ্য একটা ম্যাসিভ অ্যাটাক হয়েছে তাই,তার জন্য সময় লাগবে আর স্টেন্ট বসাতে চাইলে সেটা কালই করা হতে পারে।অন্য  কয়েকজন  ডাক্তারের সাথে কথা বলছে ওরা এই ব্যাপার নিয়ে। কুর্চি ফোন করে এইসব জানাল মৈনাককে।

বারান্দায় মৈনাকের পাশে এসে বসলো জয়ী।

–কিরে আসার পর থেকে তো একটাও কথা বললি না!

–কি বলবো

–এখনো ওখানেই পড়ে আছিস!

এই কথার উত্তর জয়ীকে দিতে ইচ্ছে করলো না মৈনাকের।ওর কিছু কথা বলার আছে ঠিকই কিন্তু কাকে বলবে  ভেবে পাচ্ছে না, কাকে? কার কাছে ওর এই অনুভূতিগুলো সঠিক সম্মান পাবে!

**********

কসাই থেকে সুলতান

আজ সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে মাঝে মাঝে আবার আকাশ যখন পরিষ্কার হচ্ছে তখন একবারে নীল।এরমধ্যেই শিরোনাম,আরিয়ান আর রুক্সার বেরিয়েছে মর্নিং ওয়াকে,দুদিন পর রুক্সারের চোখ আবার ক্যামেরার লেন্সে।

রুক্সার বলল–এই এখানে পাখি দেখা যায় না রে!

আরিয়ান বললো– পাখি আবার কোথায় দেখা যায় না!

–আরে ধুৎ, তুই বুঝবি না, এই পাখি সেই পাখি নয় ডিয়ার, রিয়ার বার্ডস।

–শালা আমি কোনো কম্মের নই!না পারি গান গাইতে না পারি পাখি দেখাতে, তার উপর আবার কুঁড়ে।

রুক্সার বলল– অনুরাগ আঙ্কেল যেদিন অসুস্থ হল সেই রাত্রে সবার আগে তুই রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলি! মাঝরাতে তোর প্রিয় ঘুম থেকে উঠে! আর তোকে কুঁড়ে বলা যাবে না বাবু।

শিরোনাম বললো– ‘বাবু’, ‘বাবু’ করে ওকে আর কাবু করিস না।

–কেন তোর হিংসা হচ্ছে?

–তাতো একটু হচ্ছে তবে গাঁজাটা ও দারুন বানায়, I admit।

রুক্সার বললো– আসল কথাটা বাদ দিয়ে গেলি! ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট  ক্লাস ফার্স্ট,একাডেমীকে ওর ধারের কাছে আমরা কেউ নেই-

আরিয়ান বিনয়ের সুরে বললো– ও তো বই পড়লেই পারা যায়-

রুক্সার বললো– অতো সোজা!

কিছুটা এগিয়ে যাবার পর  হঠাৎ শিরোনাম সামনের একটা গাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো– ওই দেখ, সুলতান টিট!

রুক্সার বেশ কিছুক্ষণ পর  হলুদ ঝুঁটির একটা ছোট পাখি দেখতে পেলো, বললো–আরে দারুন তো, সুলতান কেনরে?

–ঠিক জানি না, মাথায় ওই হলুদ ঝুঁটিটা সুলতানদের মুকুটের মতন, তাই হয়তো! এদের আরো একটা নাম আছে, লোকাল, ‘ স্বর্নচূড়’।

রুক্সার মন্তব্য করলো– তোর রেঞ্জটা কিন্তু হেভি,”কসাই টু সুলতান”।

**********

কবে আসবে

দুপুরে লাঞ্চের পর খবর এলো, অনুরাগের অঞ্জিওপ্লাস্টি করা হয়েছে, দুটো আর্টারির ব্লক খোলা গেছে, অনুরাগ আপাতত স্টেবেল। নয়না কুর্চির ফোন থেকে আজ কথা বলে মৈনাকের সাথে– তোমরা খুব সাহায্য করলে নইলে…

মৈনাক বললো– কবে আসবে আমাদের বাড়ী, তুবুন মাসী!

নয়না পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গেলো,কিছুক্ষণ পরে বললো– তুই একদম তোর মামার মত!

–মা আর দিমমাও বলে,  মাতুলানাং ক্রম, কবে আসবে, দিমমা তোমায় দেখতে চায়-

নয়না চুপ করে রইলো, এ কথার উত্তর ওর জানা নেই।

মৈনাক বললো– সব ঠিক হয়ে গেলে তোমরা সবাই এস।

**********

বৃষ্টি ভেজা কিছু কথা

সবাই কিছুটা রিল্যাক্সড এখন। আজ রাতেই ফেরার ট্রেন, একসাথে তিস্তার পার ধরে হেঁটে চলেছে ওরা। নদী আর রাস্তা, দুইই চলেছে পাশাপাশি।একটা জায়গায় এসে নদীর পাড়ে সবাই বসে পড়লো ইতস্তত।

মৈনাক এসে বসলো সৃতামার পাশে,

–তোর সাথে কিছু কথা share করতে চাই

–কি রে!

–আমি জানি না এই কথাগুলো তোকেই বলছি কেনো ,মনে হলো তোকেই বলা যায়,কেনো মনে হলো প্রশ্ন করিস না because আমি জানিনা।নয়না আন্টির সাথে আমার মামার একটা সম্পর্ক ছিল।

–what

–yes

– কি হল, whats wrong?

–মামা রোড অ্যাকসিডেন্ট এ মারা যায়, ওদের বিয়ের সাতদিন আগে। তুবুনমাসী মানে নয়না আন্টির কথা আমি অনেকবার শুনেছি আগে, বাড়িতে, কিন্তু এটা জেনেছি এখানে আসার পর,দিম্মাকে ফোন করে।আর এখন একটা অদ্ভুত feeling হচ্ছে, জানি না কেন, অনুরাগ কাকুকে দেখলেই মনে হচ্ছে আমার মামা, এটা একটা খুব অদ্ভুতI

বৃষ্টি একটু জোরে এলো।

রুপম বললো– আজ তো সবাই চলেই যাব, চল একটু ভিজি-

নদীর জল বাড়তে শুরু করেছে।

রুক্সার বললো– না, এখানে যখন তখন জল বেড়ে যায় নদীতে, আগের বছর জলদাপাড়ায় গিয়ে প্রবলেমে পড়েছিলাম, কেউ কিন্তু জলে নামবি না।

শিরোনাম বললো– ওরে, একে তো পাহাড়ী নদী, তায় বৃষ্টি পড়ছে,  আবার বোতলে করে মাল নিয়ে এসেছি, নামবো না!

জয়ী চুপ করে একদিকে বসে ছিল,আরিয়ান গিয়ে ওকে হাত ধরে টেনে নদীর ধরে একটা পাথরের উপর দাঁড়ালো,তারপর প্রায়  শেষ হয়ে যাওয়া বোতল থেকে অবশিষ্টাংশ নদীর জলে ফেলে দিল– লুক, নো মাল-

জলের আওয়াজ বাড়তে লাগলো।

শিরোনাম রুক্সারের কাঁধে হাত দিয়ে জড়িয়ে বললো– শালা মাল পেয়ে নদীটাও মাতাল হয়ে গেলো রে, দেখ কিরকম পাগল হয়ে গেছে!

বৃষ্টির আওয়াজ বাড়ছে, বাড়ছে নদীর জল,ছুটে চলেছে তিস্তা পাগলের মতো।

সৃতমা ওদিক থেকে বলে উঠলো ‘..পিয়ে উচ্ছল তরল প্রলয় মদিরা..”

শিরোনাম বললো– কি?

সৃতমা গুনগুন করে গাইতে শুরু করলো “…পিয়ে   উচ্ছল তরল প্রলয়মদিরা   উন্‌ -মুখর তরঙ্গিণী ধায় অধীরা,.…”

মৈনাক যোগ দিলো সেই গানে “…কার নির্ভীক মূর্তি তরঙ্গদোলে কল  মন্দ্ররোলে।

এই তারাহারা নিঃসীম অন্ধকারে কার তরণী চলে….”

বৃষ্টি বেড়ে চললো, সাথে নদীর জল, ওরা ফিরে চললো ভেজা পথ ধরে।

মৈনাক সৃতমাকে বললো– তুই তো ফাটানো গান গাস রে-

–কেনো এর আগে শুনিস নি?

–না এভাবে কখনো নয়,আর রবীন্দ্রনাথের গান কোনোদিনও তোর গলায় শুনি নি, কেন রে?

–তোর সামনে ভয় করে!

–তাহলে আজ যে গাইলি!

–কে জানে, হঠাৎ ভয়টা কেটে গেল-

সামনের রাস্তা বৃষ্টির অবয়বে অন্ধকার আর বৃষ্টির জলরঙে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, ওরা সাতজন, আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে আবছয়াতে…

শেষ

administrator

Related Articles