পিতৃ তর্পণ

পিতৃ তর্পণ

মালা চক্রবর্তী

‘বাবা আমার প্রথম পুরুষ,সব পেয়েছির দেশ,

চৈত্র দিনের ঝরা পাতায় মন কেমনের রেশ।’

মনে আছে বাবা, আমি তখন ফাইভে পড়ি আর ভাই ক্লাস ওয়ান। ছুটির দিনে তুমি চাপাকলে স্নান করতে গেলে আমি অপেক্ষায় থাকতাম কখন তুমি পিঠে সাবান দিতে ডাকবে। সাবান দেওয়া হলে যেই তুমি বালতি তুলে মাথায় জল দিতে যাবে,  অমনি আমি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতাম তোমাকে আর ভাই ছুটে এসে আমাকে। তোমার মাথা থেকে জল গড়িয়ে পড়তো আমার মাথায়, আমার মাথা থেকে ভাইয়ের মাথায়।সে কী আনন্দ! সে কী উচ্ছ্বাস! যেন মানুষ ঝরনা। রান্নাঘর থেকে কুটনো কাটতে কাটতে ঠাকুমার সে কী হাসি!

তখন বর্ষার শেষ। শরৎ আসি আসি করছে। আমাদের উঠোনের মাঝখানে একটা মস্ত শিউলি গাছ। সারা গাছে সাদা শিউলির কুড়ি। উঠোনে মাদুর পেতে তুমি আর আমি। আকাশে চাঁদ, কাঁসার থালার মতো চাঁদ। টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছে অচিন দেশে। যেতে যেতে বলে যাচ্ছে, ‘এবারের মতো সব ঘড়া শেষ, আবার সামনের বছর। আমাদের ভুলো না কিন্তু! ‘মনে মনে বলি চাইলেই কী ভোলা যায় সব কিছু! মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো কালো মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছিল চাঁদকে। চারিদিকে তখন চাপ চাপ অন্ধকার। তুমি বললে,  ‘জানিস জীবনে এই ভাবে দুঃখ আসে। আর এরপর কী আসবে জানিস?  সু … খ। বলতে বলতেই আলোর বন্যা। সেদিন নারকেল পাতা চুঁইয়ে পড়া জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে ভেবেছিলাম, সত্যি কী সুন্দর সুখ! কত সহজ সুখের ঠিকানা!

তারপর হঠাৎ তোমার অসুখ ধরা পড়ল। তখন আমি ক্লাস নাইন। না-সারা অসুখ। তারপর পাঁচটা বছর ডাক্তার, হাসপাতাল, নার্সিংহোম, নানা রকম পরীক্ষা… তুমি তিল তিল‌ করে এগিয়ে গেলে মৃত্যুর দিকে। আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি বাবা! সারা রাত জেগে বসে থাকতাম তোমার বিছানার পাশে। কতদিন স্কুলে যেতে পারিনি। স্কুলের পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছে তখন সবে ফুল আসতে শুরু করেছে। নীল আকাশে, লাল ফুলগুলো কেমন টানতো আমাকে।গ্রুপ থিয়েটার করতাম, কবিতা লিখতাম। সব ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছেড়ে চলে গিয়েছিল প্রথম ভালোবাসাও।সুখ নিয়ে ছিল তার কারবার। ভয় পেয়েছিল সে, যদি দুঃখ বইতে হয়! একদিন তুমিও স্বেচ্ছায়… । চিরকুটে লিখে গেলে, ‘আমার জন্য তোরা শেষ হয়ে যা, চাইনি। ক্ষমা করিস।’

জানো বাবা তারপর থেকে ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে বেরাতো। একটা ফাঁকা ধূ ধূ মাঠে একটা একা তালগাছ। পেছনে বহু দূর পর্যন্ত ধূসর আকাশ। আকাশে কোনো পাখি নেই। এমনকী ঘাসে কোনো জলফড়িংও।

স্বপ্নটা এমন কিছু নয়। তবু ঘুমটা ভেঙে যাওয়ার পর কেমন পাগল পাগল লাগতো।

এর পরের দিনগুলো শুধু লড়াই… অসুস্থ মা,  ছোটো ভাই আর বৃদ্ধা ঠাকুমা। আসলে যতদিন বেঁচে থাকা, ততো দিনই তো লড়াই। আর সুখ কী জান? অনেকটা সেই হ য র ল ব -এর গেছো দাদার মতো। মনে করো তুমি যদি যাও উলুবেড়ে তার সাথে দেখা করতে তিনি তখন থাকবেন মতিহাড়ি আবার তুমি মতিহাড়ি গেলে, তিনি তখন রামকেষ্টপুর। ঠিকানা থাকলেও দেখা করার উপায় নেই।

ভাই চাকরি পেয়েছে। বিয়ে করেছে। কী সুন্দর একটা ছেলে হয়েছে ওদের। আমিও বিয়ে করবো না ভেবেও, করেই ফেললাম। আজও আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েদের অধিকারের জায়গাটা পোক্ত হয়ে ওঠেনি।মা বলল,’ বিয়ে না করলে,ভাই এর সংসারে গলগ্রহ হয়ে থাকবি!’ যে বাড়িটা আমি চোখের সামনে তৈরি হতে দেখেছি, কারন তিন পিসিকে বিয়ে দিয়ে, সারা জীবন তাদের পাশে বাবা না থাকার দুঃখ বুঝতে না দেওয়া তুমি ওই মাইনেতে কত বুঝে চলে ওই বাড়িটা  একটু একটু করে তৈরি করেছিলে। কতদিন আমি যে গাঁথনীতে জল দিয়েছি স্কুল থেকে‌ এসে।এক বছর তো পুজোয় জামা নিইনি। বলেছিলাম, ‘বড়ো ঘরের দেওয়াল আলমাড়িটা করো।’  সেই বাড়িটায় আমি বেশি হয়ে গেলাম বাবা!

চলবে…

administrator

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Subir Das , July 4, 2021 @ 9:22 am

    একটা ভালো লেখা পড়লাম।

Comments are closed.